পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১

আকিদা

 


 

 

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মত হচ্ছে তারা আখেরাতে কোনো ব্যক্তির জন্য জান্নাত বা জাহান্নামে যাওয়ার অকাট্য সাক্ষ্য প্রদান করে না।


তবে যাদের ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট ভাষ্য এসেছে তাদের ব্যাপারটি আলাদা। যেমন জান্নাতের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে এসেছে, জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন, উক্বাশাহ ইবন মুহসিন, সাবেত ইবন কায়েস ইবন শাম্মাছ, ‘আম্মার, বিলাল, সুহাইব, আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘উদ প্রমুখ। 


[ইবন আবিল ইযয আল-হানাফী, শারহুল আকীদাতিত ত্বাহাওয়িয়্যাহ ২/৫৭৩] 


শাইখুল ইসলাম আবু ইসমাঈল আস-সাবূনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘বান্দাদের শেষ পরিণতি অস্পষ্ট, কেউ জানে না, তার শেষ কাজ কিসের ওপর সম্পন্ন হয়, তাই নির্ধারণ করে কারো ব্যাপারে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত সাক্ষ্য দেয় না যে সে জান্নাতী, অনুরূপ কারো ব্যাপারে সে এটাও সাক্ষ্য দেয় না যে, সে জাহান্নামী; কারণ এটি তাদের কাছে গায়েবী বিষয়, যার জ্ঞান তাদের নেই।’ 


[আকীদাতুস সালাফ আসহাবুল হাদীস পৃ. ২৮৬]


তবে এসবই আখেরাতের বিধানের বিষয়ে, কিন্তু দুনিয়ার বিধানের বিষয়ে যে কেউ কুফর বা শির্ক বা নিফাক প্রকাশ করবে তাকে সেটা অনুসারে বিধান প্রদান করা হবে, সে অনুসারে তাদের দুনিয়ার বিচার সংঘটিত হবে, সেটা অনুসারে তাদের শেষকৃত্যানুষ্ঠান করা হবে, তাদের সম্পদের মীমাংসা করা হবে, তাদের পরিবারের অন্যান্য বিধান নির্ধারিত হবে, তাদের ব্যাপারে কাফের বা ঈমানদার বলা যাবে।   


ইমাম ইবন আবিল ইযয আল-হানাফী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কারও ব্যাপারে নির্ধারণ করে জান্নাতের সাক্ষ্য প্রদান করা যাবে কি না এ ব্যাপারে তিনটি মত রয়েছে, 


এক. নবীগণ ব্যতীত আর কারও জন্য এ সাক্ষ্য না দেয়া। এ মতটি মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যাহ ও আওযা‘ঈ থেকে বর্ণিত।


 দুই. যাদের ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নায় সরাসরি স্পষ্ট ভাষ্য এসেছে তাদের সবার জন্য জান্নাতের সাক্ষ্য প্রদান করা যাবে। 


এ মতটি অধিকাংশ আলেম ও আহলুল হাদীসগণ গ্রহণ করেছেন। 


তিন. যাদের ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর সরাসরি স্পষ্ট ভাষ্য এসেছে এবং যাদের ব্যাপারে ঈমানদারগণ সাক্ষ্য প্রদান করেন, তাদের জন্যও জান্নাতের সাক্ষ্য প্রদান করা যাবে। এ মতটি অগ্রহণযোগ্য মত।  


এ ব্যাপারে বিস্তারিত দেখুনঃ


১- লালেকাঈ, শারহু উসূলি ই‘তিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ ১/১৬৯

২- আশ‘আরী, মাক্বালাতুল ইসলামিয়্যীন, পৃ. ২৯৩-২৯৪

৩- সাবূনী, আকীদাতুস সালাফ পৃ. ৮৩

৪- শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১১/৫১৮, ১৮/৩১৩-৩১৪

৫- ইবন আবিল ইয্য আল-হানাফী, শারহুল আকীদাতিত ত্বাহাওয়িয়্যাহ ২/৫৩৭-৫৩৮


আরেকটি বিষয় এখানে আলোচনায় আসতে পারে যে, কুরআনের কারীমে তো আল্লাহ তা‘আলা কয়েক জায়গায় মুমিনদের জন্যও বিভিন্ন কারণে আগুনে প্রবেশের ব্যাপারে ‘খুলুদ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন, তা দ্বারা কি জাহান্নামে স্থায়ী হওয়া বুঝায় না? যেমনঃ


মীরাসের বিষয় বর্ণনার পর যারা মীরাসের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হবে ও সীমালঙ্ঘন করবে, তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে। 


﴿وَمَن يَعۡصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُۥ يُدۡخِلۡهُ نَارًا خَٰلِدٗا فِيهَا وَلَهُۥ عَذَابٞ مُّهِينٞ ١٤ ﴾ [النساء : ١٣،  ١٤]  

 [সূরা আন-নিসা: ১৪]


অনুরূপভাবে মুমিনকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করার পর হত্যকারীর জন্য জাহান্নামে ‘খুলুদ’ স্থায়ী হওয়ার কথা বলা হয়েছে,  


﴿وَمَن يَقۡتُلۡ مُؤۡمِنٗا مُّتَعَمِّدٗا فَجَزَآؤُهُۥ جَهَنَّمُ خَٰلِدٗا فِيهَا وَغَضِبَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ وَلَعَنَهُۥ وَأَعَدَّ لَهُۥ عَذَابًا عَظِيمٗا ٩٣ ﴾ [النساء : ٩٣]  


[সূরা আন-নিসা: ৯৩] 


অনুরূপ সুদখোরের ব্যাপারে বলা হয়েছে, 


﴿ٱلَّذِينَ يَأۡكُلُونَ ٱلرِّبَوٰاْ لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ ٱلَّذِي يَتَخَبَّطُهُ ٱلشَّيۡطَٰنُ مِنَ ٱلۡمَسِّۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ قَالُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡبَيۡعُ مِثۡلُ ٱلرِّبَوٰاْۗ وَأَحَلَّ ٱللَّهُ ٱلۡبَيۡعَ وَحَرَّمَ ٱلرِّبَوٰاْۚ فَمَن جَآءَهُۥ مَوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّهِۦ فَٱنتَهَىٰ فَلَهُۥ مَا سَلَفَ وَأَمۡرُهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِۖ وَمَنۡ عَادَ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٢٧٥ ﴾ [البقرة: ٢٧٥]  


অনুরূপ যিনা ব্যভিচারের ব্যাপারে বলা হয়েছে, 

﴿وَٱلَّذِينَ لَا يَدۡعُونَ مَعَ ٱللَّهِ إِلَٰهًا ءَاخَرَ وَلَا يَقۡتُلُونَ ٱلنَّفۡسَ ٱلَّتِي حَرَّمَ ٱللَّهُ إِلَّا بِٱلۡحَقِّ وَلَا يَزۡنُونَۚ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ يَلۡقَ أَثَامٗا ٦٨ يُضَٰعَفۡ لَهُ ٱلۡعَذَابُ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَيَخۡلُدۡ فِيهِۦ مُهَانًا ٦٩ ﴾ [الفرقان: ٦٨،  ٦٩]  


 [সূরা আল-ফুরক্বান: ৬৮-৬৯]


তদ্রূপ গুনাহের পর গুনাহে যে ডুবে আছে তার জন্যও বলা হয়েছে, 

﴿بَلَىٰۚ مَن كَسَبَ سَيِّئَةٗ وَأَحَٰطَتۡ بِهِۦ خَطِيٓ‍َٔتُهُۥ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٨١ ﴾ [البقرة: ٨١]  

[সূরা আল-বাক্বারাহ: ৮১] 


অন্য আয়াতে এসেছে, 


﴿ وَٱلَّذِينَ كَسَبُواْ ٱلسَّيِّ‍َٔاتِ جَزَآءُ سَيِّئَةِۢ بِمِثۡلِهَا وَتَرۡهَقُهُمۡ ذِلَّةٞۖ مَّا لَهُم مِّنَ ٱللَّهِ مِنۡ عَاصِمٖۖ كَأَنَّمَآ أُغۡشِيَتۡ وُجُوهُهُمۡ قِطَعٗا مِّنَ ٱلَّيۡلِ مُظۡلِمًاۚ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٢٧ ﴾ [يونس : ٢٧]  

 [সূরা ইউনুস: ২৭]


আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণ এর কয়েকটি উত্তর দিয়েছেন,


১- জাহান্নামই এদের আসল শাস্তি, যদি আল্লাহ শাস্তি দিতে চান, কিন্তু তিনি ওয়াদা করেছেন যে, শির্ক ও সে পর্যায়ের গুনাহ ব্যতীত সকল গুনাহ তার ইচ্ছাধীন। তাই কোনো ঈমানদার জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে না। 


[ইবন কাসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ২/৩৮০; বাগাওয়ী, তাফসীর মা‘আলিমুত তানযীল ২/২৬৭; ইবন আবী হাতেম, তাফসীরুল কুরআনিল হাকীম ৩/১০৩৮, নং ৫৮১৯; ওয়াহেদী, আত-তাফসীরুল ওয়াসীত্ব ২/৯৯; ইবন আতিয়্যাহ, আল-মুহাররারুল ওয়াজীয, ২/৯৪; ইবনুল জাওযী, যাদুল মাসীর ১/৪৫০; নাসাফী, মাদারিকুত তানযীল ওয়া হাক্বায়িকুত তা’ওয়ীল, ১/৩৮৫; আবু হাইয়ান, আল-বাহরুল মুহীত্ব ৪/২৭] তারা সকলে এমতটিকে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু ও অনেক সালাফ থেকে বর্ণনা করেছেন। 


২- এখানে ‘খুলুদ’ অনেক দিন থাকা, চিরস্থায়ী হওয়া নয়। এজন্য লক্ষ্য করবেন যে, এর পরে ‘আবাদান’ আসেনি।


[এ মতটি গ্রহণ করেছেন ইবন আতিয়্যাহ আল-আন্দালুসী, আল-মুহাররারুল ওয়াজীয ফী তাফসীরিল কুরআনিল আযীয ১/১০৯-১১০; আবু হাইয়্যান আল-আন্দালুসী, আন-নাহরুল মাদ মিনাল বাহরিল মুহীত্ব ১/৮৮; আবু আব্দুল্লাহ আল-কুরতুবী, আল-জামে‘উ লি আহকামিল কুরআন ১/২৪১; নিযামুদ্দীন আল-কুম্মী আন-নাইসাপুরী, তাফসীর গারায়িবুল কুরআন ওয়া রাগায়িবুল ফুরক্বান ১/২০১; মুস্তাফা আল-মারাগী, তাফসীরুল মারাগী ১/৬৯; মুহাম্মাদ আব্দুহু, তাফসীরুল মানার ১/২৩৪]


৩- কারও কারও মতে, এ ‘খুলুদ’ তখনই হবে যখন কেউ হালাল মনে করে তা করার কারণে ঈমান থেকে বেরিয়ে যাবে। সাধারণ অবস্থায় নয়। [আবুল মু‘ঈন আন-নাসাফী, তাবসিরাতুল আদিল্যাহ ২/৭৭৪; ইমামুল হারামাইন আল-জুওয়াইনী, আল-ইরশাদ, পৃ. ৩২৬]


৪- এগুলো বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। যাদের মধ্যে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়ার মত অপরাধ ছিল যেমন, কুফরী, শির্কী কিংবা নিফাক্বী। এ মতটি পছন্দ করেছেন, জামালুদ্দীন আল-কাসেমী। [তাফসীরুল কাসেমী ২/১১০]


আল্লাহ আমাদেরকে তার দীন বুঝার তাওফীক দিন। মু‘তাযিলা, খারেজীদের ভ্রান্ত মতবাদ থেকে হিফাযত করুন। কুরআন ও সুন্নাহর ভাষ্যকে সমন্বয় করে বুঝে মধ্যম পন্থায় থাকার সুযোগ দিন। কুরআন ও সুন্নাহর ভাষ্যকে খারেজী ও মু‘তাযিলাদের মত বাড়াবাড়ি ও মুরজিয়াদের মত ছাড়াছাড়ি থেকে বাঁচিয়ে দিন। আমীন।

 

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks