![]() |
তাকলীদ ও ইত্তেবার মধ্যে পার্থক্য 🛑
তাকলীদঃ 💢
তাকলীদের শাব্দিক অর্থঃ তাকলীদও মাযহাবে মত একটি আরবি শব্দ যার আভিধানিক অর্থ হল অনুসরণ করা, নকল করা, অনুকরণ করা, বেড়ী লাগানো, গলায় তরবারি ঝুলানো, কুরবানির জন্তুর গলায় মালা পড়ানো, হার পড়ানো ইত্যাদি। ‘তাকলীদ’ (التقليد) শব্দটি ‘ক্বালাদাতুন’ (قلادة) হ’তে গৃহীত। যার অর্থ কণ্ঠহার বা রশি। যেমনঃ বলা হয়, قَلَّدَ الْبَعِيْرَ ‘সে উটের গলায় রশি বেঁধেছে’। সেখান থেকে ‘মুক্বালিলদ(مقلد) যিনি কারো আনুগত্যের রশি নিজের গলায় বেঁধে নিয়েছেন। সাধারণত মাযহাবের অনুসরণ কে তাকলীদ বলে। মাযহাব আলোচনায় এই পরিভাষাটিও ব্যবহৃত হবে। তাই তাকলীদ সম্পর্কে জেনে নেই।
তাক্বলীদের পারিভাষিক অর্থঃ
দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার জন্য দলীল প্রমাণ না জেনে, সুধারনার উপর ভিত্তি করে, কোন ব্যাপারে অন্যের কথা গ্রহণ করা বা অন্যের কথা ও কাজকে সঠিক বা সত্য জেনে, বিশ্বাস করে, দলীলের চিন্তা ব্যতিরেকে, তার অনুসরণ করাকে তাকলীদ বলে। সাধারণ অর্থে তাকলীদ বলতে বুঝায় প্রচলিত চার মাযহাবের কোন মাযহাবকে দলীলের চিন্তা ব্যতিরেকে অন্ধের মত অনুসরণ করা। তাক্বলীদ হ’ল শারঈ বিষয়ে কোন মুজতাহিদ বা শরী‘আত গবেষকের কথাকে বিনা দলীল-প্রমাণে চোখ বুজে গ্রহণ করা‼️
তাকলীদ এর আভিধানিক অর্থ গলার হার পরিধান করান। তাকলীদের পাবিভাষিক সঙ্গা হল,
অন্যের উক্তি বা কর্ম সঠিক এরূপ সুধারনার ভিত্তিতে কোন দলির প্রমান না দেখে তার অনুসরন করা। যেন অনুসারী ব্যক্তি অন্যের কথা বা কাজকে প্রমান তলব ছাড়া নিজের গলার হার বানিয়ে নিল।
(“ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” পৃষ্ঠা – ৪৩৯)।
হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘মুসাল্লামুছ ছুবূত’ এ লিখিত আছে, ‘তাকলীদ হলঃ (নবী ব্যতীত) অন্য কারো কথার উপর দলীল প্রমাণ ছাড়া আমল করা।
যেমনঃ সাধারণ মানুষ (মূর্খ) তার মত আরেকজন মুজতাহিদের কথাকে গ্রহণ করা। তবে নবী করীম (ছাঃ) বা ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা এই (তাকলীদের) অন্তর্ভুক্ত নয়। অনুরূপভাবে সাধারণ মানুষের মুফতীর দিকে এবং বিচারকের সাক্ষীর দিকে প্রত্যাবর্তন করা (তাক্বলীদ নয়)। কেননা দলীল এ দু’টিকে ওয়াজিব করেছে। কিন্তু প্রচলিত আছে যে, সাধারণ মানুষ মুজতাহিদের মুকাল্লিদ।
ইমাম (শাফেঈ মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত) ইমামুল হারামাইন বলেছেন, ‘এই (সংজ্ঞার) উপরেই অধিকাংশ উছূলবিদ (একমত) আছেন’।
(মুসাল্লামুছ ছুবূত (ছাপা : ১৩১৬ হিঃ), পৃঃ ২৮৯; ফাওয়াতিহূর রাহমূত ২/৪০০)।
আশরাফ আলী থানবী দেওবন্দীর ‘মালফূযাত’ গ্রন্থে লিখিত আছে,
‘এক ভদ্রলোক জানতে চান যে, তাক্বলীদের স্বরূপ কি?
তাকলীদ কাকে বলে?
তিনি বললেন,
দলীল ছাড়া উম্মতের কারো কথা মানাকে তাকলীদ বলে। তিনি আরয করলেন যে, আল্লাহ ও রাসূলের কথা মানাকেও কি তাকলীদ বলা হবে?
(থানবী) বললেন, আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম মানাকে তাকলীদ বলা হবে না। একে ইত্তিবা বলা হয়’।
(আল-ইফাযাতুল ইয়াওমিয়াহ মিনাল ইফাদাতিল ক্বওমিয়াহ/ মালফূযাতে হাকীমুল উম্মত ৩/১৫৯, বচন নং ২২৮)।
হাফেয ইবনু হাজার আসকলানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ) বলেছেন,
‘কতিপয় ইমাম এ থেকে (এই মাসআলাকে) আলাদা করেছেন। কেননা তাকলীদ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, দলীল ছাড়া অন্যের কথা গ্রহণ করা। আর তার উপর নবুয়াতের প্রমাণের সাথে সাথে দলীল কায়েম হয়ে যায়। এমনকি তার দৃঢ় বিশ্বাস এসে যায়। সুতরাং সে নবী করীম (ছাঃ) থেকে যা শ্রবণ করেছে তার কাছে তা নিশ্চিতরূপে সত্য। যখন সে এ আক্বীদা পোষণ করবে তখন সে মুক্বাল্লিদ নয়। কেননা সে অন্যের কথাকে দলীল ছাড়া গ্রহণ করেনি। আর এটাই সকল সালাফে ছালেহীনের পুরাপুরি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি যে, এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীছ থেকে যা তাদের নিকটে প্রতীয়মান হয়েছে তা গ্রহণ করা। ফলে তারা ‘মুহকামাত’ (কুরআনের সুস্পষ্ট হুকুম-আহকাম সংক্রান্ত আয়াতসমূহ)-এর উপর ঈমান এনেছেন এবং ‘মুতাশাবিহাত’ (যার মর্মার্থ অস্পষ্ট)-এর বিষয়টি তাদের প্রতিপালকের নিকট সোপর্দ করে দিয়েছেন
(যে তিনিই এর অর্থ ভাল জানেন)।
(হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) লিখেছেন,
وَالتَّقْلِيدُ لَيْسَ بِعِلْمٍ بِاتِّفَاقِ أَهْلِ الْعِلْمِ
‘আলেমদের ঐক্যমত অনুযায়ী তাক্বলীদ কোন ইলম নয়’।
(ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ২/১৮৮)।
ইত্তেবাঃ 💞
তাকলীত আলোচনার মাঝে ইত্তেবা আর একটি পরিভাষার সাথে পরিচিত হই, তা হলে তাকলীদ বুঝা সহজ হবে। কারন বেশীরভাগ আলেমই ইত্তেবা কে তাকলীদ হিসাবে চালিয়ে দেন।
ইত্তেবাঃ ইত্তেবা (تبع) আরবি শব্দ। কুরআনুর কারিমে বহু স্থানে ইত্তেবা (تبع) শব্দটি এসেছে। আভিধানিক শব্দটি অর্থে ইত্তেবা (تبع) অর্থ হলঃ কারো পদচিহ্ন দেখে দেখে চলা। এ শব্দটি অনুসরণ, অনুকরণ, মান্যকরণ, আদর্শ জ্ঞান করণ ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়।
শরিয়তের পরিভাষায় ইত্তেবাঃ ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায়, শরীয়তের সকল বিষয় তথা ‘আক্বিদা-বিশ্বাস, আমল, অখলাক, কথা বার্তা, হারাম হালাল, আশেষ নিষেধ, গ্রহণ- বর্জন সহ সর্বক্ষেত্রে রাসূলের পরিপূর্ণ অনুসরণ করাকে ইত্তেবা বলে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরীয়তের যে কাজটি যেভাবে করেছেন বা করতে বলেছেন সেটি ঠিক সেভাবে করাই হল রাসূলের ইত্তেবা বা অনুসরণ। শতভাগ রাসূলের ইত্তেবা ছাড়া কোন ইবাদত শুদ্ধ হয় না। এ কারণেই ইবাদতের ক্ষেত্রে রাসূলের ইত্তেবার কোন বিকল্প নাই, কারন তিনিই একমাত্র শরীয়ত প্রনেতা। আর রাসূলের ইত্তেবা সম্পর্কে এবং আল্লাহর রাসূল কোন কাজ কিভাবে করেছেন সে সম্পর্কে জানতে হলে হাদিস বা সূন্নাহ অধ্যয়ন ছাড়া আর কোন পথ নাই। কেবল হাদিস বা সূন্নাহের অধ্যয়নের মাধ্যমে রাসূলের ইত্তেবা সম্পর্কে জানা যাবে।
আল কুরআনে ইত্তেবার গুরুত্বঃ
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা রাসূল (সাঃ) এর ইত্তেবা করার নির্দেশ দেন। ইত্তেবা কথাটি কুরআনুল কারিমে ১৭৪ বার উল্লেখ করছেন। আর (সাঃ) এর ইত্তেবা ফরজ করেছের কারণ আল্লাহর রাসূল হল আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি দূত। তাকে ইত্তেবা করলেই হেদায়েত ও সরল পথের সন্ধান মিলবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
﴿وَأَنَّ هَٰذَا صِرَٰطِي مُسۡتَقِيمٗا فَٱتَّبِعُوهُۖ وَلَا تَتَّبِعُواْ ٱلسُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمۡ عَن سَبِيلِهِۦۚ ذَٰلِكُمۡ وَصَّىٰكُم بِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٥٣ ﴾ [الانعام: ١٥٣]
অর্থঃ আর এটি তো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার ইত্তেবা কর এবং অন্যান্য পথ ইত্তেবা করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এ গুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর”।
(সুরা আনাম ৫:১৫৩)।
মহান আল্লাহ কুরআনে কারিমে ওহী ভিত্তিক আমল করাকেই ইত্তেবা বলে উল্লেখ করেছেন। নিম্মর আয়াতগুলী যার প্রমাণ বহন করে।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
﴿قُلْ إِنَّمَا أَتَّبِعُ مَا يُوحَى إِلَيَّ مِنْ رَبِّي هَذَا بَصَائِرُ مِنْ رَبِّكُمْ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾
অর্থঃ বল, আমিতো তারই ইত্তেবা করি, যা আমার নিকট আমার রবের পক্ষ থেকে ওহীরূপে প্রেরণ করা হয়। এটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ। আর তা হিদায়াত ও রহমত সে কওমের জন্য যারা ঈমান আনে।
(সূরা : আ‘রাফ-২০৩)।
আল্লাহ্ বলেন,
﴿اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ﴾
অর্থঃ তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ হতে যা নাযিল করা হয়েছে, তা ইত্তেবা কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের ইত্তেবা করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর
(আ‘রাফ-৩)।
আল্লাহ্ বলেনঃ
﴿وَاتَّبِعُوا أَحْسَنَ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ﴾
অর্থঃ আর ইত্তেবা কর উত্তম যা নাযিল করা হয়েছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে
(যুমার-৫৫)।
আল্লাহ্ বলেনঃ
﴿قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِي إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ﴾
অর্থঃ বল, আমার নিজের পক্ষ থেকে এতে কোন পরিবর্তনের অধিকার নেই। আমিতো শুধু আমার প্রতি অবতীর্ণ ওহীর ইত্তেবা করি। নিশ্চয় আমি যদি রবের অবাধ্য হই তবে ভয় করি কঠিন দিবসের আযাবের
(সূরা : ইউনূস-১৫)।
আল্লাহ্ বলেনঃ
﴿وَهَذَا كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ مُبَارَكٌ فَاتَّبِعُوهُ وَاتَّقُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ﴾
অর্থঃ আর এটি কিতাব- যা আমি নাযিল করেছি- বরকতময়। সুতরাং তোমরা তার ইত্তেবা কর এবং তাক্বওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও
(সূরা : আনআম-১৫৫)।
আল্লাহ্ বলেনঃ
﴿اتَّبِعْ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ﴾
অর্থঃ তুমি ইত্তেবা কর তার, তোমার প্রতি যা ওহী প্রেরণ করা হয়েছে তোমার রবের পক্ষ থেকে। তিনি ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই । আর মুশরিকদের থেকে বিমুখ থাক
(সূরা : আনআম-১০৬)।
আল্লাহ্ বলেনঃ
﴿قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعًا مِنَ الرُّسُلِ وَمَا أَدْرِي مَا يُفْعَلُ بِي وَلَا بِكُمْ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ وَمَا أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ مُبِينٌ﴾
অর্থঃ বল, ‘আমি রাসূলদের মধ্যে নতুন নই। আর আমি জানি না আমার ও তোমাদের ব্যাপারে কী করা হবে? আমার প্রতি যা ওহী করা হয়, আমি কেবল তারই ইত্তেবা করি। আর আমি একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র।



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন