শনিবার, ১০ জুলাই, ২০২১

আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার.

 






বল, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি ঊষার প্রতিপালকের কাছে।[১]

তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট হতে। [১]

অনিষ্ট হতে রাত্রির, যখন তা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়। [১]

এবং ঐসব আত্মার অনিষ্ট হতে, যারা (যাদু করার উদ্দেশ্যে) গ্রন্থিতে ফুৎকার দেয়। [১]

এবং অনিষ্ট হতে হিংসুকের, যখন সে হিংসা করে। [১]

 

 


 

 

বল, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি ঊষার প্রতিপালকের কাছে।[১]

[১] الفَلَق এর সহীহ অর্থ হল, ঊষা বা প্রভাতকাল। এখানে বিশেষ করে 'ঊষার প্রতিপালক' এই জন্য বলা হয়েছে যে, যেমন আল্লাহ তাআলা রাতের অন্ধকারকে দূরীভূত করে দিনের উজ্জ্বলতা নিয়ে আসতে পারেন, তেমনি তিনি ভয় ও আতঙ্ক দূর করে আশ্রয় প্রার্থীকে নিরাপত্তা দান করতে পারেন। অথবা মানুষ যেমন রাত্রে এই অপেক্ষা করে যে, সকালের উজ্জ্বলতা এসে উপস্থিত হবে, ঠিক তেমনিভাবে ভীত মানুষ আশ্রয় প্রার্থনার মাধ্যমে (নিরাপত্তা লাভে) সফলতার প্রভাত উদয়ের আশায় থাকে। (ফাতহুল ক্বাদীর)

তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট হতে। [১]

১] এটি একটি ব্যাপকার্থবোধক বাক্য। এতে শয়তান ও তার বংশধর, জাহান্নাম এবং ঐ সমস্ত জিনিস হতে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে, যার দ্বারা মানুষের ক্ষতি হতে পারে।

অনিষ্ট হতে রাত্রির, যখন তা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়। [১]

এবং ঐসব আত্মার অনিষ্ট হতে, যারা (যাদু করার উদ্দেশ্যে) গ্রন্থিতে ফুৎকার দেয়। [১]

১] النَّفَّاثَات শব্দটি হল স্ত্রীলিঙ্গ, যা النُّفُوس উহ্য বিশেষ্যর বিশেষণ। مِن شَرِّ النفوس النَّفَّثَات অর্থাৎ, গ্রন্থি বা গিরাতে ফুৎকারকারী আত্মার অনিষ্ট হতে আশ্রয় প্রার্থনা। এ থেকে উদ্দেশ্য হল, যাদুর মত জঘন্য কর্মের কর্তা নর ও নারী উভয়ই। মোটকথা, এ দিয়ে যাদুকরের অনিষ্ট থেকে পানাহ চাওয়া হয়েছে। যাদুকর মন্ত্র পড়ে পড়ে ফুঁক মেরে গিরা দিতে থাকে। সাধারণতঃ যাকে যাদু করা হয়, তার চুল অথবা কোন ব্যবহূত জিনিস সংগ্রহ করে তাতে যাদু করা হয়।


এবং অনিষ্ট হতে হিংসুকের, যখন সে হিংসা করে। [১]


১] হিংসা তখন হয়, যখন হিংসাকারী হিংসিত ব্যক্তির নিয়ামতের ধ্বংস কামনা করে। সুতরাং তা থেকেও পানাহ চাওয়া হয়েছে। কেননা, হিংসাও এক জঘন্যতম চারিত্রিক ব্যাধি; যা মানুষের পুণ্যরাশিকে ধ্বংস করে ফেলে।



বল, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের প্রতিপালকের নিকট। [১]

যিনি মানুষের মালিক। [১]

যিনি মানুষের উপাস্য। [১] 

আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হতে। [১] 

যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে।

জ্বিন ও মানুষের মধ্য হতে। [১]

 

বল, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের প্রতিপালকের নিকট। [১]

১] رَبّ (প্রতিপালক) এর অর্থ হল যে, যিনি শুরু থেকেই -- মানুষ যখন মাতৃগর্ভে থাকে তখন থেকেই -- তার তত্ত্বাবধান ও লালন-পালন করতে থাকেন; পরিশেষে সে সাবালক ও জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে যায়। তাঁর এই কাজ শুধু কিছু সংখ্যক লোকের জন্য সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা সকল মানুষের জন্য ব্যাপক। আবার কেবলমাত্র সকল মানুষের জন্যই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তিনি সমস্ত সৃষ্টির প্রতিপালন করে থাকেন। এখানে কেবল 'মানুষ' শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে মানুষের সেই মান ও মর্যাদাকে ব্যক্ত করার জন্য যা সকল সৃষ্টির উপরে রয়েছে।



যিনি মানুষের মালিক। [১]


১] যে সত্তা সমস্ত মানুষের প্রতিপালন ও তত্ত্বাবধান করে থাকেন; তিনিই হলেন সকল কিছুর মালিক, অধিপতি ও রাজা হওয়ার উপযুক্ত।

যিনি মানুষের উপাস্য। [১]

১] যিনি সমগ্র বিশ্বের পালনকর্তা এবং যাঁর হাতে সারা দুনিয়ার বাদশাহী, তিনিই হলেন সর্বপ্রকার ইবাদত ও উপাসনা পাওয়ার যোগ্য এবং তিনিই সমস্ত মানুষের একক মাবূদ (উপাস্য)। সুতরাং আমি সেই সুমহান ও সুউচ্চ সত্তার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।


আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হতে। [১]

[১] الوَسوَاس শব্দটি কিছু উলামার নিকট ইসম ফায়েল (কর্তৃকারক) مُوَسوِس এর অর্থে ব্যবহার হয়েছে। আর কিছু সংখ্যক উলামা বলেন, এর আসল হল ذِي الوِسوَاس অসঅসা বা কুমন্ত্রণা গুপ্ত শব্দকে বলা হয়। শয়তান তার অনুপলব্ধ পদ্ধতিতে মানুষের অন্তরে নানা প্রকার প্রলোভন, কুমন্ত্রণা বা ফুসমন্ত্র দিয়ে থাকে; তাকেই 'অসঅসা' বলা হয়। الخَنّاس শব্দের অর্থ হল সরে পড়ে আত্মগোপনকারী। এটি শয়তানের গুণবিশেষ। যেহেতু যখন কোন স্থানে আল্লাহর যিকর করা হয়, তখন সে স্থান হতে শয়তান সরে পড়ে এবং যখন কেউ আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন হয়, তখন সে তার অন্তরে ছেয়ে যায়।

যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে।

জ্বিন ও মানুষের মধ্য হতে। [১]

[১] অর্থাৎ, এই কুমন্ত্রণাদাতা হল দুই শ্রেণীর। (১) শয়তান জ্বিনঃ শয়তান জ্বিনদেরকে মহান আল্লাহ মানুষকে ভ্রষ্ট করার ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন। এ ছাড়া প্রত্যেক মানুষের সাথে একজন শয়তান সাথী হিসাবে সদা বিদ্যমান থাকে; সেও তাকে ভ্রষ্ট করার প্রচেষ্টায় থাকে। হাদীসের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন নবী (সাঃ) ঐ কথা লোকদেরকে বললেন, তখন সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনার সাথেও কি শয়তান বিদ্যমান থাকে। তিনি উত্তরে বললেন, "হ্যাঁ, আমার সাথেও থাকে। তবে আল্লাহ তাআলা তার বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য দান করেছেন; যার ফলে সে আমার অনুগত হয়ে গেছে। সে আমাকে মঙ্গল ব্যতীত কিছু আদেশ করে না।" (সহীহ মুসলিম, কিয়ামতের বিবরণ অধ্যায়) অনুরূপ অন্য হাদীসে এসেছে যে, একদা নবী (সাঃ) যখন ই'তিকাফ অবস্থায় ছিলেন তখন তাঁর পবিত্রা সহধর্মিণী স্বাফিয়্যাহ (রাঃ) তাঁর সাক্ষাতে (মসজিদে) এলেন। সময়টা রাত্রিবেলা ছিল। সাক্ষাতের পর তিনি তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাঁর সঙ্গে বের হলেন। রাস্তায় দুই আনসারী সাহাবী পার হচ্ছিলেন। তিনি তাঁদেরকে ডেকে বললেন, "এটি আমার স্ত্রী স্বাফিয়্যাহ বিন্তে হুয়াই।" তাঁরা আরজ করলেন যে, 'আপনার সম্পর্কে কি আমাদের কোন কুধারণা হতে পারে হে আল্লাহর রসূল?!' তিনি বললেন, "তা তো ঠিক কথা। কিন্তু শয়তান যে মানুষের রক্ত-ধমনীতে রক্তের মতই প্রবাহিত হয়। আমার আশঙ্কা হল যে, হয়তো বা সে তোমাদের মনে কোন সন্দেহ প্রক্ষিপ্ত করে দিতে পারে।" (সহীহ বুখারী, আহকাম অধ্যায়) (২) মানুষ শয়তানঃ মানুষের মধ্যে কিছু শয়তান আছে যারা উপদেষ্টা, হিতাকাঙ্ক্ষী ও দয়াবানরূপে এসে অপরকে ভ্রষ্ট হতে উদ্বুদ্ধ করে। কোন কোন উলামা বলেন, শয়তান যাদেরকে ভ্রষ্ট করে, তারা হল দুই শ্রেণীর। অর্থাৎ, শয়তান মানুষকে যেমন ভ্রষ্ট করে তেমনি জ্বিনকেও ভ্রষ্ট করে থাকে। তবে এখানে মানুষের অন্তরের উল্লেখ তার ভ্রষ্টতার তুলনামূলক আধিক্যের কারণে করা হয়েছে। নচেৎ জ্বিন সম্প্রদায়ও শয়তানের কুমন্ত্রণায় ভ্রষ্টতার শিকার হয়। কিছু সংখ্যক উলামা বলেন, কুরআনে জ্বিনদের জন্যও 'রিজাল' (পুরুষ মানুষ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। (সূরা জিন ৭২:৬ নং আয়াত) সুতরাং তারাও মানুষ শব্দে শামিল।

 

 

















কোন মন্তব্য নেই: